বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ইসলামী বীমা। Islami insurance In Bangladesh

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ইসলামী বীমা

বীমা কি? 

সাধানণভাবে বীমা হলো কোনো ব্যক্তি ও কোনো বীমা কোম্পানির মধ্যাকার একটি চুক্তি যেখানে বীমা কোম্পানি একটি নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বীমা গ্রহীতার অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির জন্য আর্থিক নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ঝুকি ব্যবস্থাপনায়  বীমা একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। বীমা বিভিন্ন প্রকার হতে পারে তার মধ্যে স্বাস্থ্য বীমা, জীবন বীমা, শিক্ষা বীমা, জানবাহন বীমা ইত্যাদি। 

বীমার সূচনা

বীমা একটি ঝুকি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির বিপরীতে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। 

বীমার ইতিহাস বেশ পুরোনো, সর্বপ্রথম বীমা, "মেরিটাইম ইন্সুরেন্স" উৎপত্তি হয় ভূমধ্যসাগরীয়  অঞ্চলে ১৩ সেঞ্চুরিতে। তবে আধুনিক বীমা ধারণার বিকাশ ঘটে ১৬-১৭ সেঞ্চুরিতে। সর্বপ্রথম বীমা কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত হয় "দি ফ্রেন্ডলি সোসাইটি" যেটি ১৬৯৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্টিত হয়। কোম্পানিটি আগুন, চুরি এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে কভারেজ প্রদান করতো। 

যুক্তরাষ্ট্রে সে সময়ে স্থানীয় সামাজিক সহায়তাকারী সংগঠন গুলো বীমা সুবিধা দিয়ে থাকতো, যেটি ব্যক্তির সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় যদি সেই ব্যক্তির আসলেই প্রয়োজন হতো তাহলে কভারেজ প্রদান করতো। এই সংগঠনগুলো ধর্মীয়,সামাজিক বা অন্যান্য শ্রেণির ব্যক্তিদের দ্বারা গঠির হতো। 

পরবর্তীতে ১৯ সেঞ্চুরিতে বীমা কোম্পানিগুলো বৃহৎ পরিসরে ইন্সুরেন্স সুবিধা দেয়া শুরু করে। সেখানে বীমা গ্রহীতাদের সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন  ধরণের বীমা পলিসি যুক্ত করা হয় এবং ক্রমাগত বেশি ঝুকির ক্ষেত্রে আর্থিক নিশ্চয়তা দেয়া হয়। 

বর্তমান সময়ে এসে বীমা অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, এখন পৃথিবীর সমস্ত দেশেই বীমা কোম্পানির বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে আর্থিক পরিকল্পনার  ক্ষেত্রে বীমা এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ব্যক্তি,ব্যবসায় প্রতিষ্টান সহ সমস্ত  সংগঠন তাদের আর্থিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির উপর বিশ্বাস রেখে চলেছে। 

বীমা সম্পর্কে ইসলামীক বিধান

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান যেখানে মানব জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা জানি যে আমাদের ধর্মে স্পষ্ট ভাবে সুদকে হারাম করা হয়েছে। কিন্তু বীমার ক্ষেত্রে সুদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কারণ বীমা প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে আমরা যা প্রদান করি নির্দিষ্ট সময় পরে বীমা কোম্পানি তার চেয়ে বেশি পরিমাণে অর্থ আমাদেরকে ফেরত দিয়ে থাকে যেটা স্পষ্টভাবে সুদ হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সরাসরি লেনদেনের মাধ্যমে যদি কোনো ব্যক্তি যে পরিমান অর্থ প্রদান করে তার চেয়ে বেশি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করতে পারবে না , যদি সে গ্রহণ করে তবে সেটা সরাসরি সুদ হিসেবে বিবেচিত হবে। 

এছাড়াও মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারাহ  ২৭৫ নাম্বার আয়াতে স্পষ্টভাবে সুদকে হারাম ঘোষোণা করেছেন, তিনি বলেনঃ 

"আল্লাহ ব্যবসা অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম"


ঝুকি জনিত বিধি-নিষেধ

বীমাকে যদিও ক্ষতি পূরণের চুক্তি বলা হয় তবুও এখানে অবশ্যই ঝুকি বিদ্যমান রয়েছে। এখানে বীমাকারী কি পরিমাণ অর্থ প্রদান করে ভবিষ্যতে কি পরিমাণ অর্থ ফেরত পাবে বা আদেও পাবে কি না এরকম কিছু অনিশ্চয়তা রয়েছে। ঘটনা সাপেক্ষে যদি বীমা গ্রহীতা পলিসি কেনার কিছুদিনের মধ্যে ঝুকিতে পতিত হয় তাইলে বীমা কোম্পানিকে মোটা অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি দিতে হবে কারণ সময় বিবেচনায় বীমাগ্রহীতা বেশি প্রিমিয়াম দিতে পারবে না। 

অন্যদিকে যদি বীমাকারী যদি কখনো চুক্তি অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হয় তবে বীমা কোম্পানি তাকে কোনো রকম কভারেজ দেবে না (শুধুমাত্র জীবন বীমা ছাড়া)। এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ না পেলেও বীমা গ্রহীতাকে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রিমিয়াম দিতেই হবে। আবার জীবন বীমার ক্ষেত্রে বীমা গ্রহীতা জিবীত অবস্থায় কোনো ক্ষতিপূরন পাবে না। 

 সহীহ মুসলিম হাদীসে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছেঃ

তৎকালীন সময়ে আরবের কিছু প্রদেশে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি চালু ছিলো, রাসুল (স) নিজে এটাকে নিষেধ করেছেন। হাদীস টি সহীহ মুসলিমের ৩৮৮১ নাম্বারে বর্ণিত হয়েছে। 


বীমায় জোয়ার সাদৃশ্যতাঃ

বীমায় আমরা অনিশ্চিত লেমদেনের উপস্থিতি লক্ষ্য করতে পারি। এখানে প্রিমিয়াম বা কভারেজের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নিশ্চয়তা নেই, কারণ মানুষের মৃত্যু বা অন্যান্য আর্থিক ক্ষতি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হয়ে থাকে। আর ইসলামী শরীয়ত মতে এমন অনিশ্চিত লেনদেনকে জোয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

জোয়ার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি কোরআনের সূরা মায়েদার  ৯০ নাম্বার আয়াতে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। জোয়াকে তিনি শয়তানের কর্মকাণ্ডের সাথে তুলনা করেছেন এবং আমাদেরকে জোয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। 

বীমার সাথে জুলুমের সাদৃশ্যতা

বীমা গ্রহীতা যদি বীমা চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত প্রিমিয়াম পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে বীমা কোম্পানি থেকে তাদের বীমা চুক্তি বাতিল করে এবং সে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছে সেটা ও ফেরত দেয়া হয় না। যেটা ইসলামের দৃষ্টিতে জুলুমের সামীল। 

এ বিষয়ে সূরা নিসার ২৯ নাম্বার আয়াতে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের কে অন্যের সম্পদ অন্যায় ভাবে আত্নসাত করতে নিষেধ করেছেন। 

বাংলাদেশের ইসলামী বীমা 

সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ইসলামী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আই এফ এস বি বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী ইসলামী ফাইন্যান্স সার্ভিস প্রদানকারী প্রধান তিনটি শাখা (ব্যংক,ক্যাপিটাল মার্কেট ও তাকাফুল) এর সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ছিলো ২.৪৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

বাংলাদেশে ইসলামী বীমার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সাল থেকে। বর্তমানে ৭৬ টি পূর্ণাঙ্গ উইন্ডো সহ বীমা কোম্পানি রয়েছে তার মধ্যে ২৬ টি ইসলামী বীমা। 

এছাড়াও নন লাইফ বীমা কোম্পানি ৩ টি, আটটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বীমা কোম্পানি আর ১৫ টি ইসলামী বীমা সুবিধা দিয়ে আসছে। তবে সল্প সময়েব তাকাফুলের অগ্রগতি বেশ লক্ষণীয়। 

যদিও ইসলামী বীমা ব্যবস্থার প্রসার লক্ষণীয় তবে এখানে বেশ কিছু উদ্বেগের বিষয় ও রয়েছে। এর মধ্যে যথাযথ ভাবে শরীয়তের বিধান অনুসরণ, যথাযথ ডকুমেন্টের অভাব,গুণগত মান অন্যতম। বিভিন্ন অনুসন্ধানে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। 

তবে এ সমস্যা সমাধান করতে শরীয়ত সম্পর্কে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

ইসলামী বিমার সুবিধা

প্রচলিত অন্যান্য বীমার চেয়ে ইসলামী বীমা বেশকিছু বাড়তি সুবিধা দিয়ে থাকে। ইসলামী শরীয়াহ অনুসৃত হয় বলে এতে ধর্মীয় বিধিনিষেধ অনুযায়ী বীমা সুবিধা গ্রহন করা যায়। সুবিধাগুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

১। ঝুকি হ্রাসঃ ইসলামী বীমা ব্যবসায় প্রতিষ্টান বা ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষেত্রে হালাল উপায়ে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। এটি একদিকে যেমন আর্থিক নিশ্চয়তা দেয় অন্যদিকে ধর্মীয় অনুসাসন ও অনুসরণ করতে সাহায্য করে। 

২। বিনিয়োগের সুযোগঃ ইসলামী ইন্সুরেন্স কোম্পানি তাদের ফান্ড হালাল উৎসে বিনিয়োগ করে থাকে, যেমনঃ রিয়াল স্টেট,স্টক, বন্ড ইত্যাদি। এজন্য এখানে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিনিষেধ অনুসরণ করা সম্ভব। 

৩। সল্প খরচঃ প্রচলিত বীমার চেয়ে তাকাফুল বা ইসলামী বীমা তুলনামূলকভাবে কম প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বীমা সুবিধা দিয়ে থাকে।

৪। নৈতিক বিনিয়োগঃ ইসলামী বীমা কোম্পানি গুলো  নৈতিক এবং সামাজীক দায়বদ্ধতা আছে এমন খাতে বিনিয়গ করে যার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন ও হয় আবার বিনিয়োগের উদ্দেশ্য ও অর্জিত হয়। 


Share This Post

Next Post Next Post
1 Total Comment
  • Fardous Mahmud
    Fardous Mahmud ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ এ ১:০৩ PM

    Thanks For your information

Click Here For Post A comment

Articulate Avenue privacy Policy; check your comments

comment url